পরিচয়
অবন্তীর মোবাইলে মেসেজ রিংটোন বেজে উঠলো। আফসান টেক্সট করেছে। লম্বা একটা মেসেজ। অবন্তী মেসেজ পড়ে কী রিপ্লাই দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। আফসানের কী হলো? আফসান এরকম উদভ্রান্ত হওয়ার লোক নয়। বাবাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া নিয়ে একটু সমস্যার কথা সে বলেছিলো। নাকি বিয়ে নিয়ে কোন ঝামেলা হলো? আফসানের সাথে সর্বশেষ সাক্ষাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলো অবন্তী।
অবন্তী - “তুমি আমাকে বিয়ের সময় কোন রঙের শাড়ি দেবে।”
আফসান - “যে শাড়ির কোনো রং থাকবে না।”
অবন্তী - “তুমি না সহজ করে কোন কথাই বলো না।”
আফসান - “আমি যা সহজ ভাবি তোমার কাছে তা জটিল হয়ে যায়।”
অবন্তী - “আফসান, জানো, তুমি বেশ স্মার্ট্, কিন্তু রোমান্টিক নয়।”
আফসান - “ছেলেরা সারাজীবন মেয়েদের রূপের প্রশংসা করে আসছে; মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসছে, খুব সত্যি করে মিথ্যার অভিনয় করতে পারলেই নারীর কাছে রোমান্টিক হওয়া যায়। এতো সহজভাবে আমি ধরা দিতে চাই না। ”
অবন্তী - “তোমার রোমান্টিকতার ধরণ শুনি। কী এমন ফিলসফি আছে যা সত্যিকারের রোমান্টিক করে তোলে?”
আফসান - “অবন্তী রেগে যেয়ো না। সত্যি কথা বললে এমনই হয়। তথাকথিত রোমান্টিসিজমের মিথ্যা আশ্বাস আর ঢং এ ভরা। সত্যি বলতে কী ইগজাগারেশন করে তিলকে তাল করে উপস্থাপন করা হলেই তোমরা নারীরা রোমান্টিকতায় মেতে উঠো। আজ কোন পুরুষ নিরেট সত্য কথায় কোন নারীর মন জোগাতে পেরেছে বলে আমার জানা নাই।”
অবন্তী - “থাক অনেক হয়েছে”
আফসান - “না। শোনো; বি রিয়েলিস্টিক। প্রাচীন রোমান্টিজমের যুগ শেষ হয়েছে। তোমাকে আমি ভালোবাসি, তোমার সাথে আমার মনের মিল হয়েছে বলেই। হয়তো তুমি সুন্দর বলেই। তোমার প্রয়োজন আমার কাছে আছে বলেই।”
অবন্তী - “তুমি কি শুধু অবন্তীর শরীরটাকেই দেখলে? ভিতরের মানুষটাকে দেখলে না?”
আফসান - “অবন্তী জানো, সত্যিকার অর্থে আমি তোমাকে কখনো ছোট করে দেখি না। তোমার রূপ-লাবণ্য আর ব্যক্তিত্ব দুয়ে মিলে তুমি অপরূপা নিঃসন্দেহে। কিন্তু তোমার সাথেই আমৃত্যু আমি থাকবো এরমক মিথ্যা অঙ্গীকার করার লোক আমি নই। কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আজকের ভালোলাগা আগামীর অভ্যস্ততায় পানসে হয়ে যায়। আরোপিত ভালোলাগাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসা বলা যাবে না।”
অবন্তী - “আরোপিত কেন হবে? মন থেকেই ভালোবাসো; হৃদয় দিয়ে; দুটি হৃদয়ের বন্ধনে ভালোবাসা উৎসারিত হবে।”
আফসান - “ঐ বন্ধনটাই আরোপিত।”
অবন্তী - “হোয়াট? তুমি বিয়ে প্রথাকে মানছো না? ইউ আর ইনক্রিডিবল । ইজ জাস্ট লাইক লাইক টু শো ইউর উইসডম; ইউ থ্যিংক ইউ আর স্কলার, ইউ আর ডিফারেন্ট।”
আফসান - “দেখো, কে বলেছে বিয়ে প্রথাকে আমি মানছি না। সমাজের প্রচলিত রীতিতে আস্থা রাখতেই হবে। আই নো; ওয়েল ইট, ইট হ্যজ নো অলটারনেটিভ। কিন্তু বাস্তবটাকে মোকাবেলা করতে শেখো। বিবাহ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই স্বামী স্ত্রীদের এক প্রকার আরোপিত প্রেমের চর্চা করতে হয়। সত্যিকারের স্বতঃস্ফূর্ত্ স্ফুলিঙ্গসম- ভালোবাসা আরোপিত, অভ্যস্ত প্রেমে নিত্য ধরা দেয় না।”
অবন্তী - “তুমি বড্ড বেশি ওয়েস্টার্ন্ হয়ে যাচ্ছ। আমেরিকায় থেকে এসব অর্জন করেছো? শোনো, মানুষের আবেগ নামক বিষয়টি আছে বলেই মানুষ মানুষের প্রেমে পড়ে; হৃদয়ের আদান-প্রদান হয়; বন্ধন হয়; তুমি আমি এ জগতে এসেছি এ চক্রেরই হাত ধরে।” বড় অদ্ভুত ছেলে-ভাবতে ভাবতে অবন্তী আফসানকে কল করলো।
আফসান - “আফসান, তোমার কী হয়েছে? ভেঙ্গে বলো?”
অবন্তী - “আমি দুদিনের মধ্যেই আমেরিকা চলে যাচ্ছি; বাবাকে নেয়া হলো না। অবন্তী আমাকে ভুল বোঝোনা। আই এম রিয়েলি ফেডআপ। মানুষ নামক প্রাণিটির উপর থেকে আস্থা উঠে গেছে। বিয়েটার ডেট পিছানো যায় না?”
আফসান - “তুমি সহজভাবে বলো, তোমার হেয়াঁলি কথা ছাড় প্লিজ” এমন ভেঙ্গে পড়লে কেন?”
অবন্তী - “কঠিনকথা সহজভাবে বলা যায়, সহজ সত্য কথা সহজভাবে বলা যায় না-অবন্তী।”
আফসান - “কী হয়েছে বলো না, প্লিজ।”
কল কেটে গেলো ।
আফসানের টেক্সট আসলো। ‘মা-বাবার কলহ চরমে’. . .
আফসানের টেক্সট থেকে সহজভাবে অবন্তী যা জানতে পারলো, আফসানের মা-বাবার কথোপকথনটা ছিল কিছুটা এরকম:
- “দেখো হিরণ, ছেলে শুনতে পাবে, আস্তে কথা বলো।”
- “ছেলে !!! এ আমার ছেলে নয়! আমি আফসানের বাবা নই। আমি চিৎকার করে বলবো; দুনিয়ার সবাইকে শুনিয়ে বলবো আমি আফসানের বাবা নই। এসব অভিনয়।”
- “প্লিজ, আস্তে বলো; তুমি ঝামেলা বাধাবে।”
- “চুপ! মিথ্যাবাদী; তুমি আমার সাথে অভিনয় করে আসছো। ঝামেলার কী দেখেছো? দেখবে মজা?”
বিজয়া খুব হতচকিত কণ্ঠে হিরণকে থামানোর চেষ্টা করলো।
- “হিরণ আমি তোমাকে আমার প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। বিশ্বাস করো; বিজয়াকে বিশ্বাস করো; তোমার বুকে হাত রেখে বলছি এ বিজয়া তোমার সাথে অভিনয় করেনি।”
- “হাত সরাও; তুমি রাক্ষসিনী। রাক্ষসের মায়া তুমি আমাকে দেখাচ্ছো?”
- “হিরণ তুমি ভুল বোঝোনা। স্বীকার করি, আমি তোমার কাছে সত্য লুকিয়ে রেখেছি। বড় অন্যায় করেছি। ক্ষমার অযোগ্য আমি। তবু এইটুকু বিশ্বাস রাখো আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই আমি অন্যায় করার সাহস করেছি। এ জীবন তোমার জন্য;
শুধু তোমারই জন্যেই;
ব্যক্তি বিজয়ার স্বাদ-আহ্লাদ কিছু নেই;
ব্যক্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার কাছে বিলীন হয়েছি। শুধু তুমি সুখী হও বলে। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি তোমাকে সুখী করতে চাই।”
- “তুমি দূর হও আমার সামনে থেকে।”
- “ওগো, তুমি আমাকে খুন করো; তবু আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না; আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। তোমাকে সুখী করতেই আমি সত্য গোপন করেছি। বিশ্বাস করো আমি মনে প্রাণে পবিত্র আছি। ডাক্তারি সনদে তোমার ইমপোর্টেন্সির কথা জানার পর আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে- কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তোমাকে তা জানাইনি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম; আমাকে পারতেই হবে; তোমার দ্বিতীয় বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে আমি ভাল করেই জানতাম তোমার বাবা হওয়ার উদগ্র বাসনা। তোমার বিদেশ যাওয়ার আগে ডাক্তারের সহায়তা নিয়ে টেস্ট টিউব বেবি নিলাম। কখনো যে DNA Test হবে তা জানতাম না। আমেরিকা যাওয়ার এমন কী দরকার? এরকম জীবন আমি কী চেয়েছিলাম?”
অবন্তী অনেক চেষ্টা করেও আফসানের মোবাইলে ঢুকতে পারলো না। পরদিন সকালে অবন্তীর ফোন বেজে উঠলো; ওপাশে আফসান। “অবন্তী, অবাক হয়ে গেছে। বাবা গতকাল রাতে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।”
সহকারী কমিশনার,
কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট কমিশনার,
সিলেট ।
0 Comment "পরিচয় (ওয়ারি)"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন