বিজ্ঞানীদের করুণ মৃত্যু
আবদুল গাফফার রনি
নিজের বাড়ির উঠোনে আঁকিবুকি করছেন আর্কিমিডিস। নিছক ফেলনা কিছু নয়। গণিতের কোনও নতুন সূত্র হয়তো। আর্কিমিডিস যখন গণিতে ডুবে থাকেন চারপাশের জগতের কোনও খোঁজ রাখেন না। রোমানরা আক্রমণ করেছে তাঁর দেশে। যুদ্ধে তাঁর দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু আর্কিমিডিসের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি তাঁর কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ঠিক তখনই কোনও এক মাথামোটা সৈনিক এসে আর্কিমিডিসকে আত্মসমর্পন করতে বলে। হাতে তাঁর ধারালো খোলা তরবারি। আর্কিমিডিসের বয়েই গেল তাকে কেয়ার করতে। বরং তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ, বিরক্ত করো না, দেখছো না ব্যস্ত আছি!’
রোমান সৈনিক ভুলবশত হত্যা করে আর্কিমিডিসকে
মাথামোটা সৈনিক গণিতের কী বোঝে। আর্কিমিডিসকে সে চেনে না, ব্যাটা জানে শুধু যুদ্ধ করতে। আর্কিমিডিসের কথায় তার আঁতে ঘা লাগল। ‘কী, পরাজিত দেশের নাগরিকের এতবড় স্পর্ধা, এত বড় কথা বলে!’ বেকুবটা তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল আর্কিমিডিসের ঘাড়ে। সাথে সাথে আলাদা হয়ে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল আর্কিমিডিসের মাথা। পরে সেই কাটা মুণ্ড দেখে রোমান সম্রাট দুঃখ পেয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে সম্রাট তাঁর সৈন্যদের বলে দিয়েছিলেন যেন আর্কিমিডিসকে হত্যা করা না হয়। তিনি গুণের কদর করতেন। আর্কিমিডিসের কারণে বার বার হেরেছেন তিনি। আর্কিমিডিসের তৈরি আয়না পুড়িয়ে মেরেছে রোমান সৈন্যদের, তাঁর অদ্ভুত যন্ত্র ডুবিয়ে দিয়েছে বহু জাহাজ। তবু আর্কিমিডিসের প্রতি ক্ষিপ্ত নন সম্রাট। বরং এই গুণি মানুষটিকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।
১৫৬০ সাল। বিজ্ঞানের ইতহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর দিন। রোমের রাজপথ কানায় কানায় পূর্ণ। প্রতিটা বাড়ির ছাদে, প্রাচীরে, গাছে যে যেখান থেকে পারছে উঁকি দিচ্ছে মঞ্চের দিকে। রঙ্গমঞ্চ নয়। প্রাণদন্ডের মঞ্চ। আসামি জিওর্দানো ব্রুনো। অপরাধ তিনি ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এজন্য তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নয়, গর্দান কেটে নয়, আগুনে পুড়িয়ে ! বিচারকের তেমনই হুকুম তাঁর রক্তের এক ফোঁটাও যেন পৃথিবীর সাথে না মেশে। পুড়িয়ে মারলে তো আর রক্ত পৃথিবীতে মিশতে পারবে না।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, এই মত প্রচারের অপরাধে জিয়োর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়
ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চে। ভারী-লোহার শিকলে তাঁর হা-পা বাঁধা। জীভও বেঁধে রাখা হয়েছে। বিচারকদের বড্ড ভয়, কী জানি মৃত্যুর আগে ব্রুনো কোন্ সত্যি কথা বলে যান ! দন্ড কার্যকরের ঠিক আগ মুহূর্তে ব্রুনোকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বেঁচে থাকার। এজন্য তাঁকে দোষ স্বীকার হবে। বলতে হবে, তিনি যা বলেছেন ভুল। ব্রুনো মাথা নত করে বাঁচতে চাননি। এরপর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাত-পা, নাক-মুখে আগুন লেগে যায়, চুল-দাড়িও জ্বলে ওঠে। নিজেই পরিণত হন জীবন্ত অগ্নিকুন্ডে। তবু মরার আগে একবারও আর্তচিৎকার বেরোয়নি তাঁর ব্রুনোর দিয়ে ।
কী এমন অপরাধ করেছিলেন ব্রুনো। ব্রুনো বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই। পৃথিবী ও বিশ্বজগৎ চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে।
গ্যালিলিওর ঐতিহাসিক বিচার, কোপার্নিকাস আর ব্রুনোর মত প্রচারের অপরাধে আট বছর বন্দি জীবন কাটিয়ে মারা যান গ্যালিলিও
তোমরা হয়ত হাসছ। ভাবছ, এ-তো সত্যি কথা। এর জন্য ব্রুনোকে মরতে হলো কেন ? হ্যাঁ, একালের ছেলেমেয়েরা যে সত্যিটা জানে, তখনকার বাঘা বাঘা প-িত আর ধর্ম যাজকদেরও এই জ্ঞানটুকু ছিল না। ওরা মনে করত পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সব গ্রহ-নক্ষত্র। বাইবেলে নাকি এমন কথাই লেখা ছিল। তাই ব্রুনো যা বলছেন সবই ধর্ম বিরোধী। তাদের আশঙ্কা ব্রুনোর মতবাদ ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবী ধর্মহীন হয়ে পড়বে, সব মানুষ পরিণত হবে শয়তানে। তাই ব্রুনোকে হত্যার এই বিশাল আয়োজন। অথচ ব্রুনোর সেই সত্যির ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী।
গ্যালিলিও অন্ধ। যে চোখ দুটো দিয়ে তিনি দূরবীন দিয়ে মহাকাশ দেখেছিলেন, নতুন নতুন গ্রহ-উপগ্রহ দেখেছেন, সেই চোখ দুটিই এখন অন্ধকার। আট বছর ধরে বন্দি। বয়স আশির কোঠায়। শরীর ভেঙে পড়েছে। জীবনের এই শেষ মুহূর্তগুলোতে যদি আপনজনদের পাশে পেতেন। তা হবার জো নেই। যাজকরা তার কাছে কাউকে ভিড়তে দেবে না। এভাবে আর কদ্দিন? ধীরে ধীরে অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করতে হলো মহাবিজ্ঞানীকে। একদিকে অবশ্য ভালোই হয়েছে, পেয়েছেন দীর্ঘ আট বছরের দুর্বিষহ বন্দি জীবন থেকে মুক্তি।
কী এমন দোষ করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী ? তিনি কোর্পানিকাসের মতবাদ প্রচার করেছিলেন। বলেছিলেন, ব্রুনোকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে মূর্খ যাজকরা। এমন জন্য তাঁকে একবার মাপ চাইতে হয়েছেলি। ওয়াদা করতে হয়েছিল, চার্চ ও বাইবেল বিরোধী কিছু বলবেন না। কিন্তু সে ওয়াদা রাখতে পারেননি গ্যালিলিও। জ্বলজ্বলে তারার মত সত্যকে তিনি কীভাবে মিথ্যা বলবেন ? কীভাবে অসত্যের অন্ধকারকে আলো বলে চালিয়ে দেবেন। গ্যালিলিও সত্যের জয়গান গেয়েছিলেন আজীবন। বলেছিলেন সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে ধুকে ধুকে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন গ্যালিলিও।
১৯৪৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহটন প্রজেক্টে কাজ করেন বিজ্ঞানী লুইস স্লটিন। ম্যানহটন প্রজেক্ট হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয় বোমা গবেষণা কেন্দ্র। এখান থেকে তৈরি বোমা দিয়েই আঘাত করা হয় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে। স্লটিন খ্যাপাটে টাইপের লোক ছিলেন। তিনি তেজস্ক্রিয় পরমাণু নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। নিউক্লিয়ার বোমার অন্যতম উপদান তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম। কিন্তু প্লটোনিয়াম যেখানে-সেখানে রাখলেই তা বিস্ফোরিত হবে না। এর জন্য নির্দিষ্ট ভরের প্লুটোনিয়াম একসাথে রাখতে হয়। এই ভরকে বলে ক্রিটিক্যাল ভর।
ম্যানহটনে কোনও জারেই ক্রিটিক্যাল ভরের সমান প্লুটোনিয়াম রাখা হয় না। ওই পরিমাণ প্লুটোনিয়ামকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলাদা জারে রাখা হত যাতে ওগুলো বিক্রিয়া করে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে না পারে।
লুইস স্লটিন পারমানবিক বোমার সাথে খেলতে গিয়ে মারা পড়েন
কিন্তু স্লটিনের ছিল বদ খেয়াল। তিনি প্রতিদিন একবার করে প্লুটোনিয়াম নিয়ে খেলতেন। এক জারে রাখা প্লুটোনিয়াম আরেক জারের প্লুটোনিয়ামের ভেতরে ঢালতেন। এতে দুই জারের প্লুটোনিয়াম একসাথে হয়ে ক্রিকিটাক্যাল ভরে পৌঁছে যাবার কথা।
স্লটিন অত্যান্ত সতর্ক। একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি জারের ভেতর একটা স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে খানিকটা প্লুটোনিয়াম আলাদা করে ফেলতেন। প্লুটোনিয়াম আর ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছতে পারত না। সুতরাং নিরাপদেই খেলাটা দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন স্লটিন।
একদিন এই খেলার করুণ সমাপ্তি ঘটল। স্লটিন সময় মতো জারের ভেতর স্ক্রু ড্রাইভার ঢোকাতে পারলেন না। তাতেই ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছে গেল। শুরু হলো ভয়াবহ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। জারের ভেতর থেকে ঝলসে উঠল নীল আলোর বিকিরণ। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর সেই বিকিরণের শক্তি। আগুনের হলকায় ঝলসে গেলেন স্লটিন। ঝলসে গেলেন সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীও। অন্যদের অবস্থা অত মারাত্মক নয়। স্লটিন দুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সেই দুদিন না বাঁচলেই বরং কষ্ট কম হত। তার শরীর ভেতর থেকে ঝলসে গিয়েছিল। অত্যন্ত যন্ত্রণা নিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন।
0 Comment "বিজ্ঞানীদের করুণ মৃত্যু - আবদুল গাফফার রনি (নিংশিং চে - ২০১৬)"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন